নয়া সকাল প্রতিবেদক:
মানুষের চারিত্রিক সৌন্দর্য বিকাশ ও ব্যক্তিত্ব গঠনে ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। ভালো গুণের চর্চা ও মন্দ স্বভাব পরিহারের মাধ্যমে আদর্শ ব্যক্তিত্ব গঠন ইসলামী শরিয়তের অন্যতম উদ্দেশ্য। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা দানে প্রেরিত হয়েছি।’ (মুয়াত্তায়ে মালিক, হাদিস : ৮)
আত্মসম্মানবোধ মানুষের ব্যক্তিত্বের অন্যতম প্রধান দিক। আত্মসম্মানহীন মানুষ মানবীয় অনেক গুণাবলি থেকে বঞ্চিত। ইসলাম মানুষকে আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন হতে বলে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মুমিন আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন আর আল্লাহ তাদের বেশি আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৭৬১)
আল্লাহর আত্মমর্যাদা সবচেয়ে বেশি
ইসলাম ব্যক্তির আত্মমর্যাদাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। তবে মুমিনের আত্মমর্যাদা সীমা নির্ধারণ করে দিয়ে বলেছে, ‘সব হারাম আত্মমর্যাদার পরিপন্থী।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহর চেয়ে বেশি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কেউ নেই। এ জন্য তিনি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সব ধরনের অশ্লীলতা হারাম করেছেন। প্রশংসা আল্লাহর সবচেয়ে পছন্দের। তাই নিজের প্রশংসা নিজে করেছেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৫৮)
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী (সা.) বলেছেন যে, আল্লাহ তাআলার আত্মমর্যাদাবোধ আছে এবং আল্লাহর আত্মমর্যাদাবোধ এই যে যেন কোনো মুমিন বান্দা হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে না পড়ে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫২২৩)
আত্মমর্যাদা ঈমানের অংশ
আত্মমর্যাদা মানুষকে সৎ হতে এবং সৎপথে চলতে উদ্বুদ্ধ করে—তাকে আল্লাহর নৈকট্য লাভে সাহায্য করে। তাই রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আত্মমর্যাদা ঈমানের অংশ আর আচরণে উগ্রতা কপটতার লক্ষণ।’ (সুনানে বায়হাকি : ১০/২২)
মহানবী (সা.) আরো বলেন, ‘এমন কিছু আত্মসম্মানবোধ আছে যা মহান মহিয়ান আল্লাহ পছন্দ করেন, আবার আত্মসম্মানবোধ এমনো আছে যা মহান আল্লাহ অপছন্দ করেন। …আল্লাহ তাআলার পছন্দনীয় আত্মসম্মানবোধ হলো সন্দেহ ও বদনামের ক্ষেত্রে যে আত্মসম্মানবোধ কাজ করে। আর আল্লাহর অপছন্দনীয় আত্মসম্মানবোধ হলো সন্দেহ ও বদনামের ক্ষেত্র ছাড়া অন্যত্র যে আত্মসম্মানবোধ কাজ করে। (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ২৫৫৮)
মুমিনের আত্মমর্যাদা
আল্লাহর সবচেয়ে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন। কোরআনে মুমিনকে আল্লাহর রং ধারণ করতে বলা হয়েছে। তাই ঈমানের দাবি হলো, মুমিন আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন হবে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমরা আল্লাহর রং ধারণ করলাম। রঙে আল্লাহর চেয়ে কে বেশি সুন্দর? এবং আমরা তাঁরই ইবাদত করি।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৩৮)
মুমিনের আত্মমর্যাদার বিকাশ ঘটে আল্লাহর আনুগত্য ও সত্জীবন যাপনের মাধ্যমে। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে পরিচ্ছন্ন জীবন কাটানোর মাধ্যমে। এই পরিচ্ছন্ন জীবনের অংশ হিসেবে ইসলামী শরিয়ত কিছু বিধান প্রণয়ন করেছে। যেমন—
১. নারীর পর্দা : মানবসভ্যতার সূচনা থেকে নারীর সম্মান ও সম্ভ্রমকে তার পরিবার ও গোত্র নিজের সম্মান হিসেবে গণ্য করে। বিশেষত পুরুষের জন্য তার স্ত্রীর সম্মান ও সম্ভ্রম আত্মসম্মানের বিষয়। তাই ইসলাম নারীর সুরক্ষার জন্য পর্দার বিধান ফরজ করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘তারা (মুমিন নারী) যেন সাধারণত প্রকাশ পায় এমন ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে, তাদের ঘাড় ও বুক যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে।’ (সুরা নুর, আয়াত : ৩১)
২. দৃষ্টি সংযত করা : কুদৃষ্টি নারীকে বিব্রত ও লজ্জিত করে এবং পরিবারের পুরুষ সদস্যদের আত্মমর্যাদা তাতে আহত হয়। কুদৃষ্টি নারী-পুরুষ উভয়কে বিপদের দিকে ঠেলে দেয়। তাই ইসলাম পুরুষ ও নারী উভয়কে দৃষ্টি অবনত রাখতে বলেছে। আল্লাহ বলেন, ‘মুমিনদের বলুন! তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থান হেফাজত করে। এটাই তাদের জন্য উত্তম। তারা যা করে নিশ্চয়ই আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবগত।’ (সুরা নুর, আয়াত : ৩০)
৩. লজ্জা ও শালীনতা : লজ্জাহীনতা মানুষকে ব্যক্তিত্বহীন করে তোলে। নির্লজ্জ মানুষ যেকোনো কাজ করতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.) লজ্জাকে ঈমানের অংশ এবং সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ বলেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘লজ্জা ঈমানের অন্তর্ভুক্ত।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৪)
অন্য হাদিসে তিনি বলেন, ‘লজ্জাশীলতার পুরোটাই কল্যাণ।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩৭)
৪. সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষা : নিজের ও পরিবারের সম্মান ও সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়ে কেউ নিহত হলে ইসলাম তাকে শহীদের মর্যাদা দান করেছে। তবে তা অবশ্যই মিথ্যা ও জাগতিক অহংকারপ্রসূত সম্মানবোধ নয়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার সম্পদ রক্ষার জন্য নিহত হলো সে শহীদ, যে ব্যক্তি তার পরিবারের (সম্মান রক্ষার) জন্য নিহত সে শহীদ, যে তার দ্বিন রক্ষার জন্য নিহত হলো সে শহীদ, যে আত্মরক্ষার জন্য নিহত হলো সে শহীদ।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৪০৯৫)
৫. আত্মশুদ্ধি : ব্যক্তিত্বের পূর্ণতা ও আত্মমর্যাদাবোধ লাভের পূর্বশর্ত আত্মা পরিশুদ্ধ করা। কেননা লোভ, লালসা, অহংকার, ঘৃণা, হিংসা, ক্রোধ ইত্যাদি মানবীয় রিপু মানুষকে আত্মমর্যাদার পরিপন্থী ও পাপ কাজে উদ্বুদ্ধ করে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘সফল ওই ব্যক্তি, যে আত্মা পরিশুদ্ধ করল এবং ক্ষতিগ্রস্ত ওই ব্যক্তি, যে তা কলুষিত করল।’ (সুরা আশ-শামস, আয়াত : ৯-১০)
কোরআনে আত্মমর্যাদাহীন মানুষের নিন্দা
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ আত্মমর্যাদাহীন নির্লজ্জ মানুষের নিন্দা করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘যখন তারা কোনো অশ্লীল কাজ করে, তারা বলে আমরা আমাদের পূর্বপুরুষকে এই কাজ করতে দেখেছি এবং আল্লাহ আমাদের এর নির্দেশ দিয়েছেন। বলুন! নিশ্চয়ই আল্লাহ অশ্লীল কাজের নির্দেশ দেন না।’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ২৮)
অন্য আয়াতে এসেছে, ‘তাদের পরে এলো অপদার্থ উত্তরসূরিরা, তারা নামাজ নষ্ট করল এবং লোভের বশবর্তী হলো। সুতরাং তারা অচিরেই কুকর্মের শাস্তি ভোগ করবে।’ (সুরা মারইয়াম, আয়াত : ৫৯)
আল্লাহ সবাইকে আত্মমর্যাদার দৌলত দান করুন। আমিন।
মন্তব্য
Leave a Reply